সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১
রূপালী বার্তা।।
অষ্টম বারের মত করোনা ওয়ার্ড, শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রোস্টার ডিউটি করছেন ডা. সানজিদা সহিদ। যা কিনা বরিশালে মেডিকেল কলেজে প্রভাষক হিসেবে কারো সর্বোচ্চ ডিউটি। মেডিকেল কলেজের বেসিক সাবজেক্টের প্রভাষক, যাদের রোগি দেখার কথা নয়। আপদকালিন সময়ে অতিরিক্ত হিসেবে কাজ করছেন তিনি। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে করোনা আক্রান্ত রোগীদের সেবা দেয়া এই চিকিৎসক কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করেছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে। রূপালী বার্তার পাঠকদের জন্য সেই স্টাটাসটি তুলে ধরা হলো-
নাইট ডিউটি দিয়ে আজকে শেষ হলো আমার জাতীয় হিসেবে ৮ম বারের কোভিড ডিউটি। অতীতের সব কষ্টকে অতিক্রম করে গিয়েছে এবারের ডিউটি। আমি পরকালে প্রচন্ডভাবে বিশ্বাসী। নিশ্চয়ই আল্লাহতালা তার বান্দার রূহের প্রতি মুহুর্তের কষ্ট দেখছেন।
গতকাল রাত ১০.১০ এর দিকে নীচে যখন আমি ডনিং হচ্ছিলাম, তখন উপরের আরেকজন নাইট ডক্টর প্যানিক হয়ে ফোন দিলো, বললো-আপু আপনি কোথায়? তাড়াতাড়ি আসেন। উপরে যেয়ে দেখি ইভিনিং ডাঃ দীপান্বিতা দিদিও আছেন, সব ফ্লোরের সিস্টাররা চলে এসেছে। এডি শাহীন স্যারের সাথে কথা হচ্ছে। আমাদের জায়গা নেই, অক্সিজেন মিটার পর্যন্ত নেই। ওদিকে রোগী আসছে, আমাদের লোকবল কম।
এডি শাহীন স্যার আমাকে পারসোনালি ফোন দিয়ে বললেন-সানজিদা ইমার্জেন্সিতে বলা হয়েছে যাদের অক্সিজেন লাগছে না, স্যাচুরেশন ৯৫-৯৬-৯৭ তাদের ফেরত দেয়া হচ্ছে। কিছু করার নেই। এই সিচুয়েশনে যদি কিছু করা যায়, তাহলে সেটা তুমিই পারবা। সবাইকে ডাকো, ডেকে ব্রিফিং দাও।
আমি কিছুক্ষন ভাবলাম, সব সিস্টারদের, এম এল এস এস দের ডাকলাম। বললাম-যেসব রোগীর স্যাচুরেশন ভালো তাদের মিটার খুলে আনেন। যাদের খারাপ ৫০-৬০-৭০, এখন আসছে, সারারাত আসবে তাদের দিবেন। এম এল এস এস রা কিছুক্ষণ পরে ফেরত এসে বলে-ম্যাডাম আপনি চলেন, আমরা কিছুতেই পারছি না। শেষে আমি ওয়ার্ডে হেটে মিটার খোলা শুরু করলাম,রোগীদের সে কি চীৎকার, প্যানিক অবস্থা। এছাড়া আমার আর কিছু করার ছিলো না। সিভিয়ার রোগী যারা আসছিলো, হিসেব করে তাদের দিলাম।
এর আগে মর্নিং ডিউটিতে আমাদের অক্সিজেন সিলিন্ডার এর গাড়ী আসতে দেরী করছিলো, ওদিকে সেন্ট্রাল লাইনে উপরে জায়গা ছিলো না। আমার চেয়েও কম বয়সী একটা মেয়ে পাগলের মতো দৌড়াচ্ছিলো আর আমাকে এসে বারবার বলছিলো-একটু দয়া করেন, আমার স্বামীটাকে বাচান।
আমিও একজন মানুষ, এসব সহ্য করা যায় না। আমি দীর্ঘদিন হল প্রভোস্ট এর দায়িত্ব পালন করেছি। কিছুক্ষণ চিন্তা করলাম। আমি বের হয়ে আই সি ইউর সিস্টারকে ডেকে বললাম-দেখেনতো আমাদের কোন পেশেন্ট টা একটু স্ট্যাবল। সিস্টার বললো-ম্যাডাম, ঐ কোনায় একটা পেশেন্ট এর অক্সিজেন স্যাচুরেশন ৮৮। সে এখন অক্সিজেন ছাড়াই বাথরুমে গিয়েছে। আমি সিস্টারকে বললাম-ঐ বেডের পেশেন্ট এখনি নামান, এই মেয়েটার হাসবেন্ড কে তুলুন। তার অক্সিজেন স্যাচুরেশন ৪৬। আমরা একটা শেষ চেষ্টা করি।
যখন আগের পেশেন্টকে নামাতে গেলাম, পেশেন্ট এর লোক চীৎকার করে আমাকে বললো-আমাদের পেশেন্ট এর যদি কিছু হয় তার জন্য দায়ী থাকবেন আপনি। আমি শুধু বললাম-বাবা, আমি ডাঃ। আমার সবার দিকে তাকাতে হবে।
মেয়েটার হাসবেন্ড আই সি ইউর বেডে উঠে গেলো। ওদিকে ঐ বেডের আগের মহিলা পেশেন্ট এসে দেখে তার বেড দখল হয়ে গিয়েছে। সে হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে থাকলো। মহিলা যাতে কষ্ট না পায়, এজন্য আমি তার হাতটা ধরলাম, বললাম-মা, আপনি আসেন আমার সাথে, আপনি গাড়ী আসলেই কিছুক্ষনের ভিতর অক্সিজেন পাবেন, আরেকজনকেও একটু বাচতে দিন, আপনাকে আরেকজায়গায় বসিয়ে দেই, একটু অপেক্ষা করেন।
পুরো ওয়ার্ডে রোগী, এটেন্ডেন্স, সিস্টার, এম এল এস এস চুপ হয়ে দেখছিলো। দেখছিলো আমি একজন অসহায় ডাঃ তার রোগীর হাত ধরে হেটে যাচ্ছে ধীরেধীরে। আমি পরদিন ইভিনিং ডিউটি তে যেয়ে প্রথমে ঐ রোগীর কাছে গিয়েছি, রোগী সারভাইভ করে গিয়েছে। মেয়েটা আমাকে দেখে পরদিনও কাদছিলো আর বলছিলো-“শুধু আপনার জন্য আমার স্বামী গতকাল বেচেছে। “আমার একটা দীর্ঘশ্বাস পড়লো। মনে হচ্ছিলো রোগী না, আমি নিজেই আমার লাংস দিয়ে শ্বাস নিচ্ছি।
আমি সবসময়ই বলি-জীবন এক দুদিনের ভ্রমণ। আপনার এই ভ্রমণকে আনন্দদায়ক করুন। আত্মকেন্দ্রিক হবেন না। এতে আর যাই হোক, শান্তি পাওয়া যায় না। আমার কোভিডে ডিউটির এতোবার যে কথাটা আমি বহুবার রোগীর কাছ থেকে শুনেছি-“ম্যাডাম, আপনাকে দেখলে একটু সাহস পাই।” এই কথা আমাকে আরো মানুষের পাশে দাড়ানোর অনুপ্রেরণা দেয়। আমাকে যদি আবারও জিজ্ঞেস করা হয়-সেকেন্ড টাইম আমি কি হতে চাই? আমি উত্তরে একটা কথাই বলবো-আমি বারবার একজন চিকিৎসক হয়েই জন্মাতে চাই।